প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০২৪, ১০:১৮ এএম (ভিজিটর : )
বইমেলা নিয়ে অনেক স্মৃতি রয়েছে। আনন্দ-বেদনার স্মৃতি। ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত একবারও একুশে বইমেলায় যাওয়া নিয়ে কোনো বিরতি পড়েনি। অনেক কবি, সাহিত্যিক, আবৃত্তি শিল্পী বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে। যারা এখন অনেকেই জীবিত নেই। ২০১৬-এর পর বইমেলা শুরু হলে প্রতিদিন যাওয়া হতো না। তখন মানবকণ্ঠে কাজ করার কারণে বইমেলায় যেতাম শুধুমাত্র রোববার করে। কারণ সেদিন আমার অফ ডে থাকতো।
দীর্ঘ দিন আমার বইমেলার সঙ্গী ছিলেন আমার আবৃত্তি সংগঠন স্বরূপ সাংস্কৃতিক সংসদের সহযোদ্ধা আবৃত্তি কর্মী জয় এবং তুহিন। এমন কোনো সন্ধ্যা ছিলো না আমরা স্টলে ঘুরে ঘুরে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নেইনি। আমার এক বড় ভাই কবি সোহাগ সিদ্দিকী। এখন আর আমাদের মাঝে নেই। গত বছরের বইমেলায় তাকে খুব মিস করেছি। বইমেলা নিয়ে আমার সবচেয়ে সুখের স্মৃতি হচ্ছে ২০১৪ সালের দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে আবৃত্তি সংগঠনগুলোর স্টল বসতো। আবৃত্তি সিডি নিয়ে। আবৃত্তি সংগঠন হরবোলাতে আমার সম্পাদনায় বই প্রসঙ্গ আবৃত্তি ৭৫ কবি বিক্রি হয়েছিল। আমি রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। যখন হরবোলা থেকে একটি খামে করে আমাকে বই বিক্রির টাকা দেওয়া হয়েছিল। তখন এগুলো আমি কিছুই প্রত্যাশা করিনি। একবার বাংলা একাডেমি মঞ্চে আবৃত্তি করেছিলাম ২১ ফেব্রুয়ারিতে। এবারের বইমেলায় এখন পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। তবে এ সপ্তাহেই যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রিয় বইমেলায়। কিন্তু মেলার খোঁজ-খবর প্রতিদিন রাখা হয়।
এবারের বইমেলায় সোশ্যাল মিডিয়ার একটি বড় প্রভাব দেখা গেছে। যার অন্যতম কারণ হচ্ছে একটি অসম দম্পতি! তাদের বিয়ে নিয়ে কোনো কথা বলার ইচ্ছা আমার নেই। আমি মনে করি যদি মনের মিল থাকে যেকোনো বয়সেই বিয়ের মতো একটি পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন যে কেউ। তাদের সম্পর্ক নিয়ে তারা বই লিখেছেন। তার প্রচার-প্রচারণা করেছেন। আমাদের ইউটিউবাররা তাদেরকে কেন্দ্র করে ভিউ বাড়িয়েছেন। সব কিছুই ঠিক আছে। কিন্তু আসল বিপত্তিটা হচ্ছে একদল দর্শনার্থী তাদেরকে ধুয়ো ধ্বনি দিয়ে বইমেলা প্রাঙ্গন থেকে বের করে দিয়েছেন। সেই ধ্বনিতে একজন অশ্লীল বাক্য ছুড়েছেন আপত্তিটা হয়েছে সেখানে।
পাঠক-লেখকের মুক্ত বুদ্ধি চর্চার সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে বই মেলা। এখানে কেউ বই কিনতে আসেন। কেউ প্রিয় লেখকের সঙ্গে ছবি তুলতে, অটোগ্রাফ নিতে আসেন। কেউ আসেন আড্ডা দিতে। এক সঙ্গে নানা বইয়ের ঘ্রাণ নিতেও কেউ আসেন। বই আলোচনা হবে। বই নিয়ে পাঠক তার প্রতিক্রিয়া জানাবেন লেখককে। লেখক তার বইয়ের বিষয়বস্তু তুলে ধরবে। এসব কিছুই হলো বই মেলার প্রাসঙ্গিক বিষয়। ঠিক সেরকমই একটি তাদের লেখার বই নিয়ে প্রচারণা করেছেন আলোচিত-সমালোচিত মোশতাক-তিশা অসম বয়সের দম্পতি। মুক্তবুদ্ধি চর্চার এরকম একটি বড় মঞ্চে অশ্লীল শব্দ চয়নে ধুয়ো ধ্বনি দিয়ে বইমেলার প্রাঙ্গন থেকে তাদেরকে বের করে দিতে হবে কেন? তাহলে কি আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্থ করলাম না? অনেকেই বলছেন জনাব মোশতাক লেখক না। কিন্তু মোশতাক দাবি করেছেন আগের বছরেও তার বই বের হয়েছে। তবে এবার বিয়ের ইস্যুতে তার বই ভাইরাল তকমা পেয়েছে সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে। প্রতি বছর অনেক নতুন লেখকের বই প্রকাশিত হয়। কারো বই বিক্রি হয় বা কারো হয় না। অনেক লেখক নিজে টাকা দিয়েও প্রতি বছর বই প্রকাশ করেন। প্রকাশকরা তাদের বই প্রকাশ করেন। লেখক হতে হলে সঠিক সংজ্ঞা কি এটি কারো কি জানা আছে? পাঠকপ্রিয়তা পেলেই তাকে লেখক তকমা দিতে হবে এবং পাঠকপ্রিয় না হলে তাকে লেখক বলা যাবে না? যদিও মোশতাক-তিশার বই পড়া হয়নি। তারপরও সেই সূত্রে বলতে চাই অনেক জনপ্রিয় লেখক রয়েছেন যাদের অনেক সস্তা বই রয়েছে। এরকম অসম প্রেমের গল্পের বই রয়েছে। তাদেরকে তো বইমেলা থেকে বের করে দেওয়া হয়নি? আবার অনেক লেখক আছেন যাদের লেখা বই জনপ্রিয় লেখকদের থেকেও অনেক উন্নতমানের। তাহলে কি আমরা তাদেরকে কি লেখক বলতে পারবো?
বইমেলায় মুক্ত বুদ্ধি চর্চার ওপর আঘাত এসেছে অনেকবার। মেলাতেই অনেক প্রকাশকের স্টল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হুমায়ুন আজাদের মতো লেখকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বইমেলা। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক অভিজিত রায় বইমেলা প্রাঙ্গন থেকে বের হওয়ার পর দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হয়ে খুন হন। বইমেলাকে ঘিরে সবসময় এক শ্রেণীর মানুষ মুখিয়ে থাকে প্রিয় মেলাকে বিতর্কিত করার। তারই একটি বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল এবারের বইমেলায় মোশতাক এবং তিশা দম্পতিকে ধুয়ো ধ্বনির মাধ্যমে বের করে দেওয়ার মাধ্যমে। এখন বইমেলার বেশ কিছু দিন বাকি রয়েছে। সামনে আরো কোনো অপ্রত্যাাশিত ঘটনা ঘটবে কিনা জানা নেই। এই ঘটনা নিয়ে বাংলা একাডেমি থেকে কোনো বিৃবতিও পাওয়া যায়নি। সর্বস্তরের মানুষের পদচারণায় মুখরিত প্রাণের বইমেলায় কারা আসতে পারবে, কাদের বই প্রকাশিত হতে পারবে, কী ধরনের বই প্রকাশিত হতে পারবে? এই নিয়ে বাংলা একাডেমির একটি সঠিক দিক নির্দেশনা না থাকলে হয়তো সামনে আরো কাউকে ধুয়ো ধ্বনি শুনতে হবে। লেখক-অলেখক প্রশ্নও শুনতে হবে। বইমেলায় গণমাধ্যম কর্মীদেরও রয়েছে অনেক বড় ভূমিকা। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাকে কিছু ‘গণমাধ্যমকর্মী’রাই জনসম্মুখে ভাইরাল করে ভিউ বাড়ানোর জন্য। সস্তা ভিউয়ের কনটেন্টের পেছনে না দৌড়িয়ে গণমাধ্যমকর্মী ও ইউটিউবারদের উচিত অনেক ভালো বই রয়েছে প্রচারের অভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারছে না; সেসব বই এবং বইয়ের লেখককে খোঁজে বের করা এটি তাদের এক ধরনের দায়িত্ব।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।