মহামারি কাটিয়ে ওঠা বিশ্বের কয়েকটি দেশ জড়িয়ে পড়েছে যুদ্ধ আর সংঘাতে। এ কারণে সংশ্লিষ্ট দেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি ঝরছে প্রাণ, বিঘ্নিত হচ্ছে শান্তি, স্থিতিশীলতা, সংকটে পড়ছে জীবন, জীবিকা, অর্থনীতি এবং বিপর্যস্ত হচ্ছে মানবতা। পাশাপাশি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বিশ্বের দেশে দেশ। এদিকে দু’বছর পূর্ণ হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের। এ কারণে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক অবরোধে বিশ্ব অর্থনীতিকে ব্যাপক ভাবে সংকটে ফেলছে। আবার পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকটি দেশেও চলছে অস্থিরতা। অনুরূপ আরব বসন্তের নামে মুসলিম বিশ্বের তেলসমৃদ্ধ দেশসমূহে বিরাজমান অস্থিরতায় জ্বালানি তেলের উর্ধগতিতে বিশ্ব অর্থনীতিকে চাপে ফেলছে। অন্যদিকে, পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী কাশ্মিরে থেমে থেমে উত্তেজনা, অস্থিরতা, পাকিস্তানে অভ্যন্তরীন রক্তক্ষয়ী সংঘাত এবং নতুন করে যুদ্ধ চলছে ফিলিস্তিন- ইসরায়েলের মধ্যে। চলমান এইসব যুদ্ধ, সংঘাত, অস্থিরতায় মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। এসব কারণে বেশী সংকট সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিনিয়েগ, কর্মসংস্থান ও মানুষের জীবন যাত্রায়। তদুপরি ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞ থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় সাড়ে বার লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর পালিয়ে আসা ও আশ্রয় নেওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে দুষ্টক্ষত সৃষ্টি করেছে। গতি ও মাত্রায় এটি বিশ্বে দ্রুততম ক্রমবর্ধমান শরণার্থী সংকট সৃষ্টি করেছে। মানবিক দিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দেশের জনগণ বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয়সহ সার্বিক সহায়তা প্রদান করে।
প্রসঙ্গত করোনা মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ধাক্কা দিয়েছে তা সামলে ওঠার আগেই পশ্চিমে যুদ্ধের পারদ তাতে আরো চাপ সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ শস্য রপ্তানিকারক দেশ ইউক্রেনের শস্য বিশ্বব্যাপী রপ্তানি না হওয়ায় বেশ কিছু দেশে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট এবং খাদ্যপণ্যের লাগামহীন দাম। তীব্র হয়েছে জ্বালানি সংকটও। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম তেল-গ্যাস রপ্তানিকারক রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা জোটের নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞার ফলে জ্বালানির মূল্য রেকর্ড ছুঁয়েছে। ইউরোপসহ প্রায় প্রতিটি দেশে বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতি। জ্বালানি এবং খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বেশ কিছু দেশে প্রতিবাদে রাস্তায়ও নেমেছে মানুষ।
অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়াতে অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক সংকট। পাকিস্তানে বিগত সময়ে ইমরান সরকারের পতন এবং দীর্ঘদিন ধরে চলা আভ্যন্তরীন সহিংসতায় ৫০ বছর পিছিয়ে গেছে দেশটি। পাকিস্তানের প্রতিবেশী আফগানিস্তানের চিত্র আরো করুণ। ফের দেশটির ক্ষমতায় এসেছে তালেবান সরকার। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তারা একে একে পরিবর্তন করতে থাকে প্রচলিত সব নিয়ম কানুন। তাদের ভয়ে দেশ ছেড়ছে লাখ লাখ মানুষ। স্বাধীনতা হারিয়েছে নারীরা। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে ভূমিকম্প, বন্যার মতো বেশ কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিবেশী মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রথমে একপক্ষীয় পরে এবং তাদের বিরোধী জোটের পাল্টাপাল্টি হামলায় বিপর্যস্ত মানুষের জীবন অর্থনীতি। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী অং সান সু চিকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে জান্তা সরকার। ক্ষমতায় এসে একের পর এক নৃশংসতা চালাতে শুরু করে জান্তা। মিয়ানমারের গ্রামের পর গ্রাম আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া, নারী-শিশুসহ অসংখ্য বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হয়। এরইমধ্যে সম্প্রতি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকাতেও মিয়ানমারের ছোঁড়া মর্টারশেল এসে পড়েছে। এমনকি সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মিয়ানমারের গোলার আঘাতে রোহিঙ্গা নিহতের ঘটনাও ঘটেছে। প্রায়শই সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করে।
অপরদিকে চীন-তাইওয়ানের মধ্যে চলছে উত্তেজনা। চীন সাগর অঞ্চলে সামরিক মহড়া বাড়িয়েছে চীন, ছুড়েছে বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র। সেখানে যুদ্ধ বাধার দ্বারপ্রান্ত চীন-তাইওয়ান। এ ছাড়া সম্প্রতি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ বহু মাত্রায় বাড়িয়েছে উত্তর কোরিয়া। বিগত সময়ে প্রথমবারের মতো জাপানের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে দেশটি। তাতে সামরিক মহড়া আর শক্তি দুটোই বাড়িয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি পাল্টা জবাবে ইতোপূর্বে যৌথভাবে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়া। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে আগামী বছরগুলোতে হয়তো বিশ্বব্যাপী মহামন্দা দেখা দিতে পারে। এভাবে বিশ্বের গুটিকয় দেশে যুদ্ধ, সংঘাত, পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক অবরোধের ফাঁদে পড়ে বাংলাদেশসহ স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ শোচনীয় পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনটি তার ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর বিশ্বনেতাদের খোলাখুলি আলাপ-আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করায় এবারের সম্মেলনটি বিশেষ গুরুত্ব পায়।
এমনই এক অস্থির সময়ে জামানির মিউনিখে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গেল বিশ্ব নেতাদের অংশগ্রহণে নিরাপত্তা সম্মেলন। একই সঙ্গে ক্লাইমেট সিকিউরিটি বিষয়ক সম্মেলনও। তাতে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ছয় দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করেন বিশ্ব নেতাদের সামনে। এসব প্রস্তাব পেশ করে তিনি বিশে^র কয়েকটি দেশে চলমান যুদ্ধ বন্ধ, যুদ্ধে অস্ত্র ক্রয় ও অর্থহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে এই অর্থ মানব কল্যাণে ব্যয়ের আহ্বান জানান। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনজণিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য জলবায়ু তহবিলের অর্থ দ্রুত ছাড় করার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর এসব প্রস্তাব সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিশ্ব নেতাদের মনযোগ আকর্ষণ করেছে এবং বিশ্ব নেতাদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। এ সম্মেলনের ফাঁকে বিশ্বের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকগুলোর মধ্যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠক ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দুই নেতার বৈঠকে গুরুত্ব পেয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি। জাতিসংঘের সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সমর্থন প্রত্যাশা করেছেন জেলেনস্কি। প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু প্রণীত পররাষ্ট্রনীতি, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ তিনি বলেন, মানবতার অস্তিত্ব যখন হুমকির মুখে পড়বে, তখন সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষার পথ অনুসরণ করলে তা কোনো সুফল বয়ে আনবে না। জার্মানিতে মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্স ২০২৪-এ ‘ফ্রম পকেট টু প্ল্যানেট: স্কেলিং আপ ক্লাইমেট ফাইন্যান্স’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় তিনি আরো বলেন, বিশ্বকে যুদ্ধ ও সংঘাত, অবৈধ দখলদারিত্ব এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের বিশেষ করে নারী ও শিশুদের নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে যা গাজা ও অন্যত্র বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সংঘাতের অনুভূতির বোধ থেকেও অনেক দূরে অনুভূত হয়।
জলবায়ু নিরাপত্তার ইস্যুটি নিয়ে আলোচনা হলেও চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত এবং ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা শঙ্কা নিয়েই আলোচনা প্রাধান্য পায়। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকার প্রশ্নটিও উঠে আসে। ইসরায়েলের সামরিক তৎপরতা যে সুষ্ঠু সমাধান দিতে সক্ষম নয়, বরং ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারকে বাস্তবায়ন ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসবে না সে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি নিধন বন্ধের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি বাংলাদেশের পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। একজন সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষকের মতে, যে কোনো দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভর করে সে দেশের মানুষের উন্নয়ন অগ্রগতি। যুদ্ধ সংঘাত একদিকে যেমন শান্তি, স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতি সাধিত হয় তেমনি উন্নয়ন, অগগ্রতি ব্যহত হয়। মূলত নানা অজুহাতে ধনী দেশগুলো তাদের অস্ত্র বিক্রি, কর্তৃত্ব, আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, ঋণ ব্যবসার সুবিধার্থে প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে বিশ্বের দেশে দেশে চলমান যুদ্ধ, সংঘাত, অস্থিরতার নেপথ্যে কাজ করছে। একই ভাবে আরব বসন্তের নামে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার নেপথ্যেও এই মোড়লদের সম্পৃক্ততা লক্ষ্যণীয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার পিতা বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবায়নের মধ্যেই নিহিত রয়েছে চলমান অস্থিরতা, সংঘাত, যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি। প্রত্যাশা মানব জাতির বহুল প্রত্যাশিত শান্তি, মানবতা, মানুষের কল্যাণ, অগগ্রতির স্বার্থে বিশ^ নেতারা ব্যক্তি, রাষ্ট্রীয় স্বার্থের উর্ধে ওঠে অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করবেন। তাহলেই সম্ভব যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি আসবে।
লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।